ঝুঁকি – ১

by Antarctic Artist RHADS
এখন আমি পাহাড়ের উপরে। একদম উঁচুতে। আমার সাথে আছে একজন, আজ এখানেই পরিচয়। চিনি না। চেনা মানুষ আমার পছন্দ না। ভালই হয়েছে।

আমার এখন ভয় পাওয়া উচিত। ইনি যদি আমাকে মেরে ফেলে, কেউ আমাকে হয়তো খুঁজে পাবে না, হয়তো জানবেও না। সারা জীবনের জন্য আমি নিখোঁজ হয়ে যাব। তারপর আমাকে নিয়ে হয়তো আর্টিকেল লেখা হবে, ফেসবুকে ভাইরাল পোস্ট হবে, তারপর নতুন কোন ইস্যুর জন্যে অপেক্ষা চলবে। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কাঁদবে শুধু আমার পরিবার। তাদের কথা ভেবে অন্তত এখন আমার ভয় পাওয়া উচিত। পাচ্ছি না। কারণ হয়তো ছোটবেলা থেকে এই দৃশ্য-টাই আমার স্বপ্ন। সামনে যে দিকে চোখ যায় পাহাড়, মানুষ নেই। আর রাতের আকাশ ভর্তি তারা। আর এই ঝিরঝির বাতাস। এগুলো থাকলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।
সবাই বলত এটা হেঁয়ালি। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে আসলেই মনে হচ্ছে আমার আর কিছু লাগবে না। এই পাশের মানুষ-টা আমাকে মেরে ফেললেও ঠিক আছে। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
আপাতত মানুষ-টা নিজেও অবাক যে আমি কোন ভয় পাচ্ছি না। শুধু সামনে তাকিয়ে আছি, যেমন একটা বাচ্চা প্রথম দুনিয়া দেখে তাকিয়ে থাকে। আমার চোখে এত বিস্ময়, এত নির্মল অবাক আনন্দ। যেন আমি ভাবতেই পারিনি এসব আমি কখনো দেখতে পারব।
সে হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভ্রূ কুঁচকানো। আমি তার দিকে তাকাই নি, কিন্তু বুঝতে পারছি। আমার এই স্বপ্নপূরণের খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার এই তাকানো-টা দেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি। একে ভয় পাওয়ানোর আর দরকার নেই। একদিনের জন্য যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে আজকে। কান্নাটা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
“আগে পাহাড়ে আসেন নি?”
“না। এটাই প্রথম। শেষ-ও হতে পারে। এসেছি তো জেদ করে। জেদ আর কতক্ষণ থাকে। কিন্তু শহরে ফিরতেও ইচ্ছা করছে না। শহর আর পাহাড়ের মাঝখানের একটা জীবন গড়তে পারলে ভাল হত।“
“আপনি পরিণত মানুষের মত কথা বলেন না। আপনি কি কিশোরী? কোন স্কুলে পড়েন?”
খোঁচা মারা কথা শোনার আমার অভ্যাস আছে। বংশের সবাই এভাবেই বলে আমাকে নিয়ে। কিন্তু তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। কেউ আমাকে বুঝে না এবং বুঝবেও না, তা আমি ১৩ বছর বয়স থেকে জানি। তাই মনের চামড়া ঢালের মত করে বানিয়ে নিয়েছি।
“আপনি নামতে চাইলে নামতে পারেন। আমার আপত্তি নেই।“
“এখানে একলা একটা মেয়েকে রেখে যাব? দিনকাল তো ভাল না।“
“ধর্ষণের কথা বলছেন? তা তো আজকাল অনেক মেয়েই হয়। আমার এক বান্ধবী-ও হয়েছে। আমাকে বলেছে সেটার জন্য অল টাইম মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে। এটা বাংলাদেশ। এখানে কারো শাস্তি হয়না। অতএব, এ দেশের মেয়ে হলে সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেই হবে। আর আপনি আমাকে রেখে গেছেন তা দেখবে কে এই অন্ধকারে? কাউকে কি দেখতে পাচ্ছেন?”
“ননসেন্স কথা বলবেন না। এসব শহরে ব্যাক করে আপনার রোমিও-কে শোনাবেন। আর একবার আমাকে নামার কথা বললে আমি আসলেই নেমে যাব।“
“নেমে যান।“
এই পর্যন্ত আমি একবারও তার দিকে তাকাই নি। এবারও তাকালাম না। উনি রাগে কটমট করে তাকিয়ে নেমে গেলেন। যাক, বাঁচা গেল। এবার শুধু প্রকৃতি আর আমি। আমাদের মাঝে আর কেউ নেই।
বাবাকে একটা কল করা উচিত। শুধু শুধু চিন্তা করছে হয়তো। শুধু শুধু বলছি কেন? কারণেই তো করছে। একটা মেয়ে একলা একলা চলে গেল কাউকে কিছু না বলে, চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এখানে তো কোন নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। কত না অ্যাড দেখি এক কোম্পানির, পাহাড়ে নেটওয়ার্ক পাওয়ার। ধুর, নাম মনে আসছে না। এবার ফিরেই ওদের একটা সিম কিনতে হবে। প্রকৃতির সাথে কথা বলি আপাতত।

deja vu by nanomortis

শুভরাত্রি পাহাড়। শুভরাত্রি খোলা আকাশ। তোমাদের অনেক খুঁজেছি শহরে, অনেক অপেক্ষা করেছি তোমাদের জন্যে। আজ এতদিন পর, প্রথমবারের মত, তোমাদের সঙ্গে “ডেট”। ভাবতেই ভাল লাগছে।
আমাকে কি তোমরা চেন? আমাকে কি তোমাদের আপন মনে হচ্ছে? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আমি গল্পের সেই মোগলী। মনে হচ্ছে এটাই আমার ঠিকানা ছিল মানুষের ভীড়ে যাওয়ার আগে। তোমাদের কি তেমন কিছু লাগছে?
হঠাৎ মনে হল, পেছনে কেউ এসেছে। বাহ। কয়েক মিনিটও হয়নি আমি এখানে একা। এখনই শিকারী হাজির? I am impressed!
পেছনে ফিরলাম। ফিরেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। মুখ অর্ধেক ঢেকে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই অর্ধেক-টা দেখেই আমার ভেতর-টা ধক করে উঠল।
আপু?! তুমি বেঁচে আছ???!!

Leave a Comment