এ বছরের ফেব্রুয়ারীতে অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনে বাংলাদেশী পাসপোর্ট পাওয়ার ধাপ নিয়ে বানানো অনেক ভিডিও এবং অনলাইন লেখা পড়ার পরেও আমি সঠিক তথ্য পাচ্ছিলাম না। মূলত সেগুলোতে দেওয়া প্রায় সব তথ্যই পুরনো হয়ে গিয়েছিল যা আমি বুঝতে পেরেছি প্রথম ধাপে ভুল করেই।
মার্চের শেষে এসে সফলভাবে পাসপোর্ট হাতে পাবার পর মনে হলো, নতুন যারা পাসপোর্ট নিতে চান তাদের জন্য আমার নিজের অভিজ্ঞতা-টুকু ছবি-সহ ধাপে ধাপে বর্ণনা করলে ভালো হয়। তাই আমি পুরো প্রক্রিয়াটি যতটুকু বিস্তারিত-ভাবে বলা যায় এখানে বলছিঃ
১। সঠিক ওয়েবসাইটে যাওয়া
আমি প্রথমেই যে ভুলটি করেছিলাম তা হলো ভুল ওয়েবসাইটে যাওয়া। কারণ, আমি যেসব ভিডিও এবং আর্টিকেল দেখেছিলাম, এমনকি আমি পাসপোর্টের সাহায্য চেয়ে যেই ফেসবুক পেজ-গুলোতে মেসেজ করেছিলাম, সবাই আমাকে ভুল ওয়েবসাইট-টির অ্যাড্রেস দিয়েছিলঃ passport.gov.bd – এই ওয়েবসাইট-টিতে রেজিস্টার করে আপনি কোনদিকে আগাতে পারবেন না। কারন এর ২য় পৃষ্ঠাতেই পেমেন্টের রেফারেন্স নাম্বার চায়, যেটা আপনি কোনভাবেই দিতে পারবেন না কারণ কোন ব্যাঙ্ক আপনাকে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ছাড়া পেমেন্ট করতে দিবেনা। অনলাইন পেমেন্ট করলে সামনে আগানো সম্ভব হতে পারে কিনা জানিনা ।

তাহলে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম কোত্থেকে পাবেন? সঠিক ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে – epassport.gov.bd – এটাই সেই ওয়েবসাইট যেখানে সবাই ঝামেলাহীন-ভাবে নতুন পাসপোর্টের জন্য অনুরোধ করতে পারবে। তাই এখানে গিয়ে Sign up করুন ।

২। অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন জমা দেওয়া
epassport.gov.bd-তে অ্যাকাউন্ট তৈরী করতে পারবেন নিজের জরুরী তথ্য-গুলো জমা দিয়ে। এর জন্য আপনাকে “অনলাইনে আবেদন” ট্যাবে ক্লিক করতে হবে অথবা এই অ্যাড্রেসে যেতে হবে – https://www.epassport.gov.bd/onboarding

এখানে প্রথম ধাপেই জিজ্ঞেস করবে আপনি বাংলাদেশ থেকে অ্যাপ্লাই করছেন কিনা আর করলে কোন বিভাগ থেকে করছেন। এর সাথে আপনার কাছের পুলিশ স্টেশন কোনটা সেটাও জানতে চাইবে। এভাবে আপনি সবকয়টি ধাপে তাদের চাওয়া তথ্যগুলো দিয়ে দেবেন।


২য় আর ৩য় ধাপে ইমেইল অ্যাড্রেস আর পাসওয়ার্ড চাইবে। এই ২টো তথ্য কিন্তু কোনমতেই ভুলবেন না। প্রতিবারই আপনার পাসপোর্টের সর্বশেষ আপডেট বা স্ট্যাটাস দেখার জন্য এই ইমেইল আর পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্টে ঢুকতে হবে। আর না হলে, অ্যাপ্লিকেশন জমা হওয়ার পরে, অ্যাপ্লিকেশন আইডি দিয়ে স্ট্যাটাস-টি দেখতে পারেন।
এই ধাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আপনার পাসপোর্টের ধরন, মেয়াদ এবং পৃষ্ঠাসংখ্যা ঠিক করা, কারণ এর উপর ভিত্তি করেই আপনার ব্যাংকে জমা দেওয়ার টাকার অঙ্ক-টা নির্ধারিত হবে। এই মুহূর্তে (মার্চ ২০২১) আপনি তার জন্যে নিম্নোলিখিত অপশন-গুলি পাবেনঃ
Type | Valid For | Number of Pages |
---|---|---|
Regular | 5 Years | 48 |
Express | 10 Years | 64 |
এসবের উপর ভিত্তি করে আপনার পাসপোর্ট ফি হতে পারে এগুলোর মধ্যে যেকোন একটিঃ
- Regular Passport + Valid for 5 Years + 48 Pages = 4,025 Taka / ৪ হাজার ২৫ টাকা
- Regular Passport + Valid for 5 Years + 64 Pages = 6,325 Taka / ৬ হাজার ৩২৫ টাকা
- Regular Passport + Valid for 10 Years + 48 Pages = 5,750 Taka / ৫ হাজার ৭৫০ টাকা
- Regular Passport + Valid for 10 Years + 64 Pages = 8,050 Taka / ৮ হাজার ৫০ টাকা
- Express Passport + Valid for 5 Years + 48 Pages = 6,325 Taka / ৬ হাজার ৩২৫ টাকা
- Express Passport + Valid for 5 Years + 64 Pages = 8,625 Taka / ৮ হাজার ৬২৫ টাকা
- Express Passport + Valid for 10 Years + 48 Pages = 8,050 Taka / ৮ হাজার ৫০ টাকা
- Express Passport + Valid for 10 Years + 64 Pages = 10,350 Taka / ১০ হাজার ৩৫০ টাকা
অ্যাপ্লিকেশন-টি জমা দেওয়ার আগে বা Submit Application-এ ক্লিক করার আগে দেখে নেবেন আপনার দেওয়া সবগুলো তথ্য ঠিক আছে কিনা। এর জন্য আপনি অ্যাকাউন্ট খোলার দিনই জমা না দিয়ে ২-৩ দিন সময় নিয়ে তথ্যগুলো চেক করে তারপর জমা দিতে পারেন।
৩। অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউল ঠিক করা – ২০শে ফেব্রুয়ারী
সফলভাবে অ্যাপ্লিকেশন জমা দেওয়ার পরে আপনার পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউল ঠিক করতে হবে। এটার জন্য সেই “অনলাইনে আবেদন” ট্যাবে গেলেই আপনি দেখতে পারবেন যে “Submitted” লেখার সাথে “Schedule an appointment” কথাটিও লেখা আছে। আমি আসলে এই পর্যায়ের স্ক্রিনশট নেইনি ফেব্রুয়ারিতে, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করার পরের শট-টি দিচ্ছি এখানে। প্রথমে ২৪শে ফেব্রুয়ারী অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করলেও, সেটা ক্যান্সেল করে আমি পরে ২রা মার্চের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করেছিলাম।
আপনার যদি শিডিউলের দিনে যেতে কোন সমস্যা হয়, তাহলে আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট-টি ক্যান্সেল করতে পারবেন অথবা আরেকদিন শিডিউল করতে পারবেন “Reschedule/Cancel Appointment”-এ ক্লিক করেঃ

এখানে লেখা Application Summary–টা মনে করে প্রিন্ট করে নেবেন কারণ এটা আপনার ব্যাংকে টাকা দেওয়ার সময় এবং পাসপোর্ট অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় লাগবে। এর সঙ্গে Application Form-টাও Download করে প্রিন্ট করে নেবেন।
৪। ব্যাংকে টাকা জমা – ২২শে ফেব্রুয়ারী
২ নম্বর ধাপে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আপনার পাসপোর্ট ফি-এর টাকাটি জমা দিতে হবে নির্ধারিত ৬টা ব্যাঙ্কের যেকোন একটি শাখায়। ব্যাঙ্ক-গুলো হলোঃ
- Bank Asia
- Dhaka Bank
- One Bank
- Premier Bank
- Sonali Bank
- Trust Bank
আমি ঢাকা ব্যাঙ্কের উত্তরা শাখা (জসীমউদ্দিন) থেকে দিয়েছিলাম। ফি দেওয়া শেষ হলে যেই ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা’র কাছে জমা দিলেন, তিনি আপনাকে Deposit Slip দিবে। এখানে ২টি হুবহু একইরকম স্লিপ একসাথে জোড়া লাগানো থাকবে যাতে পাসপোর্ট অফিস একটি জমা নিতে পারে এবং আরেকটি আপনার কাছে প্রমাণ হিসেবে রাখতে পারেন। অতএব, কোনমতেই এই স্লিপ-টি হারাবেন না।
৬। দরকারী কাগজপত্র তৈরী রাখা
এই বিষয় নিয়ে অনেকের অনেকরকম মতামত শুনেছি, এবং কোনটি সবচেয়ে সঠিক আমি বলতে পারবোনা। আমি একটি ফাইলে করে যা যা দরকার হতে পারে সবকিছু তৈরী করে রেখেছিলাম। সেগুলো হলোঃ
- Bank Deposit Slip
- Application Form
- Application Summary
- NID main copy
- NID photocopy
- Father’s NID photocopy
- Mother’s NID photocopy
- Birth certificate
- Electricity Bill
- নাগরিক সনদ এবং তার ফটোকপি
- প্রাইভেট জবের আইডি কার্ডের ফটোকপি
- আমার অফিস থেকে নেওয়া NOC Certificate
প্রথম ৫টি জিনিস আনা লাগবেই। বাকিগুলো ক্ষেত্রবিশেষে লাগতে পারে, নাও লাগতে পারে। তবে ই-পাসপোর্টের জন্য কোন ছবি নিয়ে যেতে হবেনা কারণ পাসপোর্ট অফিসেই আপনার ছবি তোলা হবে।
আমি আমার ফাইল-টি উত্তরার পাসপোর্ট অফিসের ম্যাডাম-কে দিয়েছিলাম। উনি কোনটা কোনটা চেক করেছেন আমি দেখিনি। সুতরাং কোনটা কোনটা লাগে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে পারছিনা দেখে দুঃখিত। Uttara RPO বা উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস অত্যন্ত দ্রুত কাজ করে এবং কোন প্রকার হয়রানি করেনা। এজন্য আসলে তারা অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতেও বলেনা। তবে অন্য অনেক RPO-তে এরকম হয়রানি করা হয় শুনেছি। তাদের জন্য উপরের কাগজপত্রের তালিকার সবকয়টি তৈরী রাখলে সবচেয়ে ভাল হয়।
৭। পাসপোর্ট অফিসে জমা, বায়োমেট্রিক এবং ছবি – ২রা মার্চ
আমি আমার ফাইলটি ৩য় তলার ম্যাডামকে দেওয়ার পরে উনি সবকিছু দেখে আমাকে ফেরত দেন এবং পাশের কাউন্টারে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে বলেন। আমি তা দেওয়ার পরে এই কাউন্টারের স্যার কাগজপত্র দেখে সাইন করে আর সিল মেরে দেন, এবং আমাকে দোতলায় যেতে বলেন।
দোতলায় আমি আরেক ম্যাডাম-এর কাছে এগুলো জমা দেইঃ
- ৩য় তলা থেকে আনা সাইন করা ও সিল মারা কাগজপত্র
- আমার এনআইডি’র ফটোকপি
- বাসার বিদ্যুৎ বিল
- Bank Deposit
এছাড়া উনি আমার মূল NID দেখতে চান এবং তারপর ফেরত দিয়ে দেন। এরপর ম্যাডাম আমার ছবি তোলেন, চোখের স্ক্যান, ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান এবং ডিজিটাল স্বাক্ষর নেন। এসবের পর তিনি আমাকে ডেলিভারি স্লিপ দেন যেটা পাসপোর্ট তোলার সময় আমার লাগবে। আমি এরপর বাসায় ফিরে আসি।
বাসায় এসে ওয়েবসাইট চেক করি এবং আমার পাসপোর্ট অ্যাপ্লিকেশনের স্ট্যাটাস দেখি “Enroled, pending approval“। এর মানে হলো, আমার অফিসে কাগজপত্র জমা দেওয়া ও বায়োমেট্রিক সফল হয়েছে। এখন পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

৮। পুলিশ ভেরিফিকেশন – ৬ই মার্চ
৬ই মার্চ সকালে আমাকে এসপি স্যার ফোন করে বলেন যে তিনি আজকের মধ্যে আসবেন ভেরিফিকেশনের জন্য। বিকাল ৩টার দিকে উনি আমাদের বাসায় আসেন এবং আমার বাবার সাথে কথা বলে দরকারী তথ্য-গুলো নোট করেন। এর সাথে আমার স্বাক্ষর নেন এবং আমাকে এসব কাগজপত্র জমা দিতে বলেনঃ
- বিদ্যুৎ বিল
- আমার NID ফটোকপি
- বাবার NID ফটোকপি
- মায়ের NID ফটোকপি
- আমার অফিসের আইডি কার্ডের ফটোকপি
যতদূর জানি, Current Address আর Permanent Address আলাদা হলে নাগরিক সনদ-এর ফটোকপিও দেওয়া লাগে। আমার এই ২টি ঠিকানা একই বলে লাগেনি।
৯। Approved থেকে Passport Received – ১১ই-২৮শে মার্চ
পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর কয়েকদিনের মধ্যে আমি পরপর এই স্ট্যাটাস-গুলি দেখি পাসপোর্ট ওয়েবসাইটেঃ
- Approved – ১১ই মার্চঃ এর মানে আপনার পুলিশ ভেরিফিকেশন সফল হয়েছে এবং আপনার পাসপোর্ট-টি বানানো হচ্ছে
- Passport Shipped – ২৪শে মার্চঃএর মানে আপনার পাসপোর্ট-টি বানানো হয়ে গেছে এবং আপনার RPO-তে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখনো RPO-তে পৌঁছায়নি
- Passport Received – ২৮শে মার্চঃএর মানে আপনার পাসপোর্ট-টি আপনার RPO-তে পৌঁছেছে এবং আপনি যেকোন দিন নিয়ে আসতে পারেন বায়োমেট্রিকের সময় পাওয়া Delivery Slip-টি দিয়ে।




১০। পাসপোর্ট অফিস থেকে তোলা – ২৯শে মার্চ
আমি Passport Received দেখার পরদিনই RPO-তে যাই কারণ তার পরের দিন (৩০শে মার্চ) শব-এ-বরাতের ছুটি। আমি সকাল ১০টায় পৌঁছাই এবং দোতলায় ডেলিভারি স্লিপ জমা দেই। সেখানের কর্মকর্তারা তখনো আসেন নি। গার্ড বলছিল যে তারা মিটিং-এ আছে। ১০ঃ৪০-এর দিকে তারা আসে এবং সবাইকে বসতে বলে।
এরপর তারা মাইক্রোফোনে একেকজনের নাম ডাকে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে তার পাসপোর্ট-টি দিয়ে দেয়। আমার এভাবে পাসপোর্ট তুলতে কোন সমস্যা হয়নি। আমি ১১টার মধ্যে আমার পাসপোর্ট-টি তুলে বাসায় ফেরত আসি।
মনে রাখবেন যে একেক RPO একেকভাবে চলে। অনেক আরপিও-তে দরকার না থাকলেও অনেক কাগজপত্র দেখাতে বলে বা টাকা দিতে বলে। আসলে এরকম অবস্থায় অসহায় হয়ে অনেকের টাকা দিতে হয় বা হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনি ১ মাস বা তারও কম সময়ে পেয়ে যেতে পারেন নিজের পাসপোর্ট।
Thanks for sharing this valuable information. I wish you best of luck.
LikeLiked by 1 person
Thank you 🙂
LikeLike